আম

Chinu Khandker
4 min readDec 30, 2022

আম কাঁঠালের মরশুম চলছে তখন I আমাদের বাসার দু’টো আমগাছে অনেক আম ধরতো I তবে তাদের তেমন কোনো বংশ পরিচয় ছিলোনা, তাই কোনো মনভোলানো নামও ছিলোনা I সবাই বলতো ‘পাতি আম’ I ওগুলো দিয়ে সাধারণত টক ডাল বা টক ঝোল রান্না করা হতো I বাজার থেকে আনা হতো সব দেখতে অপূর্ব, স্বাদে গন্ধে ভরপুর , আর বাহারী নামের সব আম I এই যেমন, ফজলী, সিন্দুরে, গোপালভোগ, হিমসাগর, খিরসাপাত, আশ্বিনা, বোম্বাই, মোহনভোগ, ইত্যাদি, ইত্যাদি I তবে আমার প্রিয় ছিল ল্যাংড়া আম I আর সব বাড়ীর মতো আমাদের বাসায়ও ঝুড়ি ভর্তি নানান ধরণের আম আসতো I আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, বান্ধব নিয়ে আম, কাঁঠাল খাওয়ার স্বাদই আলাদা I ভালো ভালো আম কিনলেই আব্বা আর মা অনেককে আসতে বলতেন I কি জানি কেন কিছুদিন যাবত সেই সময়কার একটা ঘটনার কথা বার বার মনে পড়ছিলো I ভেবেছিলাম, কখনো সুযোগ হলে ছোট মনিরকে জিজ্ঞেস করবো এটা ওর মনে আছে কিনা I

সেদিনও আমাদের বাসায় অনেকে এসেছিলেন I আমার যতদূর মনে আছে ছোট ছোট অনেকেই এসেছিলো তাদের বাবা বা মার সাথে I ভালোবাসার সম্পর্কের মনি ভাবীও ছিলেন সেদিন I ভালোবাসার ভাবী বললাম এই জন্য যে আমার জীবনে আমি আর এমন মানুষ দু’টি দেখিনি যে নাকি প্রথম পরিচয়েই যে কোনো মানুষকে এত সহজে আপন করে নিতে পারে আর ছোট বড়ো সবাই যাকে এত ভালোবাসে I ভাবী খুব হাসি, খুশী , উচ্ছল অর ভীষণ কাজের মেয়ে ছিলেন I না, কোনো আত্মীয়তার জালে নয়, বরং শুধুমাত্র ভালোবাসার জালেই আমাদেরকে আটকে রাখা এক ভাবী I সেদিন ছোট মনিরও এসেছিলো চাচী আম্মা আর ওর ছোট ভাই নাসিরের সাথে I ওদের বয়স তখন বোধহয় যথাক্রমে ছয় আর চারের কাছাকাছি ছিল I আমার ছোট ভাইয়ের নামও মনির। তবে বয়সে কিছুটা ছোট হওয়াতে মনিরুজ্জামানকে আমি ছোট মনির বলে ডাকতাম I আর মনি ভাবী ওদেরকে মিতা বলতেন নিজের নামের সাথে মিল থাকাতে I

মা আমাকে বললো সবাইকে আম কেটে দিতে I বাড়ীতে কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও কেন যেন মা আমাকে দিয়েই এই কাজটা করাতো I মাঝে মাঝে আপত্তি জানালেও বিশেষ কোনো কাজ হতোনা I তবে সেদিনের কথা আলাদা I কারণ একটাই I সকাল থেকেই আমার মেজাজ খারাপ ছিল I তার উপর সেদিন বাড়ীতে পাড়াতো বেয়াই সম্পর্কের কয়েকজন এসেছিলো মনি ভাবীর সাথে I এর মধ্যে কেউ কেউ বেশ জ্বালাচ্ছিলো আমাকে I আমার মনে হয়েছিল, আর সবার সাথে সাথে তিন মনিও বুঝে বা না বুঝেই হাসছিলো I মেজাজ আমার তুঙ্গে উঠলো I কি ভাবে শোধ নেয়া যায় ভাবছিলাম I আমের ঝুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম এটাই আমার সুযোগ I আমাকে নিয়ে হাসাহাসির মজা দেখাচ্ছি I আজ সবাইকে কুপোকাত করবো I দোষী বা নির্দোষ কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা I তাই বাজারের ভালো আমের সাথে আমাদের বাসার গাছের কিছু প্রচন্ড টক আমও কাটলাম I ছোট ছোট প্লেটে সুন্দর করে সাজালাম I জ্বালাতন করা বেয়াইদের জন্য টক আমগুলো বাইরের ঘরে পাঠিয়ে দিলাম, আর মনি ভাবী ছাড়া বাকী সব মহিলাদের জন্য মিষ্টি আম নিজে হাতে দিয়ে এলাম I আমের রং আর সাইজ দেখে সবাই খুব খুশী মনে হলো I মনি ভাবী এসে বললেন, “এই চিনু, আমারটা কোথায়?” তার কিছুক্ষন বাদে ছোট মনির এসে বললো, ‘আপা, আমারটা?” তার একটু পরেই আমার ভাই মনির এসে বললো, “চিনু, আমার আম কই ?” সবাইকে বললাম, “কাটতে হবে I কাটা হলে তোমাদেরকে একে একে ডাকা হবে তখন এসে নিয়ে যেও I” কিছু আম কেটে একটা প্লেটে রেখে ডাকলাম, “মনি, এস আম নিয়ে যাও’I মনির এসে বললো, ‘দাও I” বললাম, “তোমাকে ডাকা হয়নি I তোমারটা একটু পরে হবে I” ওর মুখটা একটু কালো হয়ে গেলো I মনির গিয়ে ছোট মনিরকে পাঠিয়ে দিলো I ছোট মনির প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপা , মনির ভাই বললো আপনি নাকি আমাকে ডাকছেন ?” “তোমাকে না I অন্য মনিকে ডেকেছি I তোমারটা রেডি করতে হবে I অন্য মনিকে পাঠিয়ে দাও I” ছোট মনি কি বুঝলো কে জানে I বেশ একটু নিরাশ হয়ে চলে গেলো Iএকটু পরে দেখি মনি ভাবী এসেছেন I “কিরে চিনু, আম কাটা হলো? তুই নাকি আমার মিতাদের খালি হাতে ফেরত পাঠিয়েছিস? “ “ হয়েছে, তবে তোমারটা এখনো বাকি আছে I “ “ বাকি আছে? তাহলে এই প্লেটটা কার? আর তুই কেন আমাদেরকে একে একে ডাকছিস আর আম না দিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছিস? তোর মতলবটা কি বলতো?” ঠিক সেইসময়ে বাইরের ঘর থেকে একজন এসে বললো, কেউ কেউ আম খেতে পারছেনা — বেজায় নাকি টক I আব্বা শুনে মাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এত দেখে শুনে ভালো নামকরা সব মিষ্টি আম কিনলাম I তা না দিয়ে সবাইকে টক আম দিলে কেন?” মা যেন কি একটা সন্দেহ করলো I আমাকে এসে বললো, “এখানেতো শুধু মিষ্টি আমের ঝুড়ি রাখা হয়েছিল I বাসার টক আমগুলো এখানে এল কি করে ?” সব মিলিয়ে বোঝা গেলো বাইরের ঘরে টক আম দেয়া হয়েছিল ইচ্ছে করেই I তার উপরে মনির, ছোট মনির আর মনি ভাবীর সাথে করা কান্ডটাও ফাঁস হয়ে গেলো I মনির আর ছোট মনির আম খেতে না পাওয়ায় আর শুধুশুধু ডেকে বোকা বানানোর নালিশ জানালো I আমি নাকি তিন মনিকে মিছেমিছি আম খাওয়ার কথা বলে ডেকেছি আর ফাঁকি দিয়েছি I আব্বা, মা’র বকাবকি শেষ হলে, মনি ভাবী এসে বললেন, “তুই আমার মিতাদের আর আমাকে এভাবে ঘোরালি কেনোরে? দিন দিন একটা পাজী হচ্ছিস I এবার খালাম্মাকে আমার দেবরের সাথে তোর বিয়ের কথা বলবো I” “তোমার দেবর? ওতো একটা আস্ত ছাগল I এক নম্বরের গুন্ডা I ওকে কে বিয়ে করবে?” “তা ঠিক I তুমি যে পাজী হয়েছো তার জন্য আমার দেবরের চেয়ে আরো এক কাঠি সরেষ কারো গলায় তোমাকে ঝুলিয়ে দেয়া হবে I”

আমাকে কারো গলায় ঝুলোবার অপেক্ষা মনি ভাবী করতে পারেননি I হঠাৎ করেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল I ভেবেছিলাম, দেখা হলে সেদিনের সেই ছোট্ট মনিরকে জিজ্ঞেস করবো এই ঘটনাটা ওর একটুও মনে আছে কিনা I কিন্তু সেটাও হলোনা, আর তা হবারও নয় I

--

--