যদি
তুমি কি কাল সকালে একবার দেখা করতে পারবে ?
হঠাৎ ?
দরকার আছে I
কোথায়?
সেন্ট্রাল বাস টার্মিনালে।
ক’টায়?
সকাল আটটায় I
ওরে বাবা, এত সকালে ? জরুরি কিছু?
খুবই I
কোথায় আসবো?
হ্যামিলটন হয়ে টরন্টো বা মন্ট্রিয়ালে যাবার একটা সাইনবোর্ড আর ওর পাশেই একটা ষ্টারবাকের স্টল। ওখানেই থাকবো আমি।
হ্যামিলটন, টরন্টো, এসব কি বলছো?
দেখা হলে বলবো। এখন রাখছি। লাইনটা কেটে গেলো।
স্টলের কাছাকাছি যেতেই ও এগিয়ে এলো। একমুখ হাসি নিয়ে বললো,
এসেছো?
ডাকলে যে। কি ব্যাপার বলতো ? হঠাৎ এখন, এখানে, এভাবে?
বলছি। শোনো I
শুনছিলাম, কিন্তু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আর পারছিলামনা চোখের পানি আটকাতে। কেন এমন হচ্ছে ? কেন এত কাঁদছি আমি? ওকেতো শুধু আমার একজন ভালো বন্ধু বলেই ভাবতে চেয়েছি, তার বাইরে অন্য কোনো ভাবনা কখনও মনে এলে নিজেকে ধমকেছি, বলেছি ও কিছুনা I আজ তবে কেন এই চোখের পানি? এটা কি শুধু মাত্র এক বন্ধুর জন্য ? “কি, তুমি কি কাঁদছো নাকি?” মাথা নেড়ে না বললাম I “চলে যাচ্ছি বলে মন খারাপ হচ্ছে? কিন্তু, কি করবো বল? আমারওতো খুব খারাপ লাগছে হঠাৎ এইভাবে চলে যেতে। কিন্তু যেতে যে আমাকে হবেই, সেটা তুমিও জানো আর তার কারণটাও তুমি বেশ ভালো করেই জানো। আমিতো তোমার কাছে আসতে চাই, অনেক কাছে, কিন্তু সেটাতো হবার নয়। বাঁধাটাতো তোমার বানানো, আমার নয়। এইযে এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা অথচ আমাদের মাঝখানে যোজন যোজন ব্যাবধান! আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমিও যে আমাকে ভালবাস সেটা তুমি নিজে জানো কিনা জানিনা, তবে আমি জানি I একদিন হয়তো তুমি সেটা বুঝতে পারবে I ভাবছ কি করে এতোটা জোর দিয়ে এই কথাটা বলছি ? তাই যদি না হবে তাহলে কেন এই কাঁদা কাটি? কি করি এখন বলতো ?” একটানা কথা বলতে বলতে ওর গলাটা একটু ভেঙে এল। আমার গলার কাছে কি একটা আটকে আছে মনে হলো I কথা বের হতে চাচ্ছিলোনা ; কোনোরকমে বললাম, “আমরা ভালো বন্ধু” I “তাই? আর কিছু নয়? ভালো, তবে একটা মিথ্যে দিয়ে নিজেকে বোঝাচ্ছ বোঝাও, দয়া করে আমাকে নাহয় নাই-ই বোঝালে ।” ওর গলার স্বরে হালকা ঝাঁঝ, ক্ষোভ, আর বিরক্তির আভাস পেলাম যেন। একটু অপরাধী মনে হলো নিজেকে। কথার মোড় পাল্টানো দরকার।
বললাম ‘পৌঁছে চিঠি দেবেতো ?” হ্যাঁ, এই দ্যাখোনা কতগুলো পোস্টকার্ড নিয়ে যাচ্ছি I” কাঁধের ব্যাগটা থেকে বেশ কতগুলো পোস্টকার্ড বের করে দেখালো। “ তুমি উত্তর দেবেতো?” “হ্যাঁ, নিশ্চয় I কিন্তু তুমিতো কোনো ঠিকানা দাওনি আমায়।” “ও, তাইতো। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, আমার যে বন্ধুর ডর্মিটরিতে ওঠার কথা ছিল, ওর সাথে কাল যোগাযোগ করতে পারিনি। ভেবেছিলাম, তোমাকে ওর ঠিকানাটা দেব। কিন্তু এখন কোথায় গিয়ে উঠবো ঠিক নেই। ঠিক হলেই তোমাকে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দেব, কেমন? বাস হ্যামিল্টনে থামবে একবার। থাকবে ওখানে বেশ কিছুক্ষন Iওখানেই একটা কার্ড পোস্ট করে দেবো। I মাটিতে চোখ রেখে মাথা নেড়ে বললাম, “ঠিক আছে।” ও আমার চিবুকটা একটু তুলে ধরে পকেট থেকে টিসু বের করে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “ আবার? এইতো বললে আমরা শুধুই বন্ধু I তার জন্য একটু মন খারাপ হতে পারে, কিন্তু এত কান্না? আর কেঁদোনা। আমি তোমার হাসি মুখটা দেখে যেতে চাই। “ বলতে ইচ্ছে করলো, “তুমি যেওনা।” পারলামনা। বোধহয় বুঝতে পারলো I ও আমার হাত দুটো ধরে বললো, “তোমার হাত খুব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে I দাঁড়াও আমি ঠিক করে দিচ্ছি।” এই বলে ও আমার হাত দু’টো একবার নিজের গালে ঠেকিয়ে তারপর বেশ করে ওর হাতের তালু দিয়ে ম্যাসাজ করে দিলো। হঠাৎ আমার পায়ের দিকে চোখ পড়াতে বললো, “ এই দ্যাখো, আবার তুমি তোমার জুতোর ফিতে ঠিক করে বাঁধনি । কতবার বলেছি জুতোর ফিতে ঠিক করে বাঁধতে। একদিন ঠিক আছাড় খেয়ে পড়বে, তখন মজা বুঝবে।” ও নীচু হয়ে আমার জুতোর ফিতে বাঁধতে গেলো। আমি তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নিয়ে বললাম, “এসব কি হচ্ছে ? লোকে দেখছে।” ও একগাল হেসে বললো, “নাহ, তোমাকে আর বদলানো গেলোনা। শুধু লোকে দেখছে আর লোকে কি বলবে। সারাক্ষন এই লোকের ভয় তোমার। এই ভয় করেই তুমি আমাকেও দূরে রাখলে আর নিজেও সেই দূরেই রইলে। এখন একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।” এই বলে ও আমার দু’পায়ের জুতোর ফিতে খুলে আবার শক্ত করে বেঁধে দিলো। আমার চোখে আবার পানি এসে গেলো। ও একটু হেসে বললো, “কি, আবার কাঁদবে নাকি? থ্যাংকস বলবেনা?” এবার আমার হাসি পেলো। হাতঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বললো,”আর দশ মিনিট বাদেই আমার বাস আসবে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। চলো ওই কোনার বেঞ্চিতে বসে কথা বলি। “ আমাকে বসিয়ে রেখে ও দু’কাপ কফি নিয়ে এল I “তোমাকে কবে তোমার দেশে ফিরতে হবে? “ “দু’মাস পরে, ফাইনালটা শেষ হবার পরে। আচ্ছা, তুমি কেন আর দুমাস অপেক্ষা করলেনা, হুট করে ঝোঁকের মাথায় এমন ভালো চাকরিটা ছেড়ে কোথায় কোন অজানা অচেনা শহরে চললে একা একা I তোমার মা বাবা খুব চিন্তা করবেন I” “হয়তো, কিন্তু তোমার মতো এতটা নয় I অবশ্য তুমিযে আমার জন্য এত চিন্তা করছো,এটা জেনে আমার খুব ভালো লাগছে, থ্যাংকস। এক কাজ করো। তুমিও চলোনা আমার সাথে। তখন আমরা দুজনে ঘুরবো একসাথে। তাহলে আর কাউকে কোনো চিন্তা করতে হবেনা। যাবে ?” হলুদ হয়ে যাওয়া বিবর্ণ এক সংস্কারের আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা আমার চিন্তা ধারণা, বিচার, আচার। কি করে এর বাইরের পৃথিবীতে পা রাখবো, জানা নেই আমার। শুধু জানি লোকলজ্জা আর ভয়। চুপ করে আছি দেখে ও বোধহয় বুঝতে পারলো। একটু ঠাট্টা করে বললো, “ও ভুলে গিয়েছিলাম তোমার সেই ‘লোকে কি বলবে’ ফোবিয়ার কথা। যাকগে, তোমার কথার উত্তর দিচ্ছি। আরও দু’মাস থেকে যাবার কথা বলছো ? সাহস নেই I গত কয়েকদিন ধরে অনেক ভেবেছি, তোমাকে বলা হয়নি Iআজ বলছি I দু’মাস কেন, দু’দিন পরেই হয়তো আবেগের বশে এমন কিছু করে ফেলতে পারি, যা শুধু দু’জন মানুষকে একান্তই আপনার করে দেয় I আমি আমার সংযম হারাচ্ছি I আর আমাদের মাঝে যে সংস্কারের দেয়াল তুমি খাঁড়া করে রেখেছো, ওটা হয়তো আর থাকবেনা আর তার কারণটা হবো আমি ই। তাই বলতে পারো, আমি পালাচ্ছি I তবে যদি কোনোদিন ডাকো, ঠিক চলে আসবো I”
বিশ বছর পরে আবার এসেছি এখানে । অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে I আমার মনটা আবার ফিরে গেলো সেই দিনগুলোতে Iখুব ইচ্ছে করছিলো একবার ওকে দেখতে, কথা বলতে । কোথায় আছে ও? কেমন আছে? ফেসবুকে খুঁজলাম, গুগল সার্চ করলাম, কোথাও পেলামনা। অনেক কিছুই পেয়েছি জীবনে, আবার অনেক কিছু হারিয়েওছি। শুনেছি, প্রথম প্রেম নাকি কখনো ভোলা যায়না । তাহলে কি ওটাই আমার প্রথম প্রেম ছিল? তবে দেশে ফিরে যাবার পরে যার সাথে বিয়ে হয়ে প্রায় বিশ বছর ঘর করলাম, যার সন্তানের মা হলাম, সেটা কি ছিল? সবাইতো আমাদেরকে একটা সুখী দম্পতি বলেই জানত। সুন্দর একটা শান্ত ধীরে বয়ে যাওয়া নদীর মতো জীবন ছিলো আমাদের। ছিলোনা কোন হঠাৎ আছড়ে পড়া ঢেউ, ছিলোনা কোনো উত্তাল তরঙ্গ, ছিলোনা কোনো বাঁধভাঙা বন্যায় ভেসে যাবার ভয়। তবে কিসের যেন একটা অভাব ছিল যেটা আমাকে কখনো কখনো ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে অনন্যমনস্ক করে দিতো, অন্য কোথাও নিয়ে যেত যেখানে শুধু বিষন্ন একা আমি কিছু একটা খুঁজে বেড়িয়েছি ? এটা কি শুধুই ফেলে আসা দিনের স্মৃতি চারণ? তাই যদি হবে তবে কেন আজও সেই দিনের ব্যাথাটা অনুভব করছি? প্রশ্ন করেছি নিজেকে, কেন ওকে দূরে সরিয়ে দিলাম? আজ কেন আমি এত উতলা, কেন মন্ট্রিয়াল, টরোন্টোতে ওকে খুঁজে ফিরছি ? কেন বারবার ভাবছি যদি কোথাও হঠাৎ দেখা হয়ে যায় ওর গালে আলতো করে হাত ঠেকিয়ে বলতে কি পারবো, “ এই দ্যাখো আমার হাত দু’টো কেমন ঠান্ডা হয়ে আছে, একটু ধরবে? “